Saturday, August 23, 2014

কৈফিয়ৎ

কৈফিয়ৎ

এরকম একটা বই করব , কোনদিনই ভাবিনি । এই লেখাগুলো নিয়ে কি করব সে রকম কোন পরিকল্পনাও ছিলো না । লিখেছি, শুধুই একান্তে; নিজেই ছিলাম তার নিজস্ব সীমানা ; সেগুলো প্রকৃতপক্ষে উপযুক্ত লেখা হয়ে উঠবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম আর হাতও বাঁধা ছিলো, কারণ সরকারের কাছে মাথা ছিলো বাঁধা,  কোন লেখা ছাপতে দিতে পারতাম না । মূলতঃ তখন ছিলাম বাংলা থেকে অনেক যোজন দূরে, যেখানে সাহিত্য পৌঁছোতে আলোকবর্ষ নিয়ে নিতে পারে ।

আমি তখন সাহিত্যবর্জিত যুদ্ধক্ষত্রে নিজেকে কম্বাট্যান্ট প্রমাণ করার জন্য অন্যান্য ভাষাভাষীদের সাথে কদমে কদম মিলিয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে প্যারেডের টার্নআউট করছি । আর ডিফেন্সে কাজ করার জন্য একটা রুল সব সময় মানতে হয়েছে কাজ করে তা হলো - হেডকোয়ার্টার কে না জানিয়ে কেউ প্রিন্ট মিডিয়াতে কিছু লিখতে পারবে না । সুতরাং কলমে তালা লাগিয়ে এটিসির টাওয়ারে পেন্সিল ঘষাঘষি করছি ।

মাত্র ১৭ বছর বয়সেই পথের ঢেলা পায়ে ঠেলে লেফট রাইট সতীর্থ দের সাথে মার্চ করে চলেছি, তাঁদের কেউ আজ অবসরে গেছেন, কেউ কেউ বা শহীদ হয়েছেন । সেই রাত্রিব্যাপী গার্ড ডিউটি, সেই যুদ্ধক্ষেত্রে গোলাবারুদ , প্যারেড গ্রাউণ্ডে বোম্ব ব্লাস্ট - এসবই ছিলো ঘটনাবহুল দিনলিপি যা এখনো তাজা স্মৃতি, লিখতে গেলে সম্পূর্ণ ফায়ারিং রেঞ্জ জুড়ে ভরে যেতে পারে লাল অক্ষর । সুযোগ হয়নি কিংবা হ্য়ত আইনের বাঁধা হাতে কলমও বাঁধা পড়েছিলো । এক দুবার নিজেরই বিরুদ্ধে এই বায়ুসৈনিক বিদ্রোহ করেনি তা নয়, যুদ্ধক্ষেত্রের লগ বুকে  এঁকেবেঁকে লিখেগেছি আবেগের গল্পকথা, হৃদয়ের গভীরের আওয়াজ ছবির মত ধরে রেখেছি ডায়েরীর পাতায় । মনে হয়েছে কেন এই যুদ্ধ ? কেন এই যুদ্ধের জন্য ওঁত পেতে থাকা ? বার বার মনে হয়েছে সভ্যতার এ কোন দিক দর্শন ?  বরং মনে হয়েছে ফিরে যাই চূর্ণির পারে যেখানে আমার কৃষক পিতা ছোট্ট পরিসরে ধানের জমিতে সবুজের ঘ্রাণ নিত । মনে হয়েছে বার বার ফিরে যাই সেই ধানক্ষেতের মাঝে যেখানে দেশের কোন সীমানা নিয়ে উতকন্ঠা নেই, নেই গোলাবারুদের কোন রাজনীতি, নিজের ভাব প্রকাশে বা কবিতা ছাপতে কোন মিলিটারী আইন কলমকে আটকে রাখে না ।

সেই স্বাধীনতার জন্যই হোক আর সার্বভৌমিকতা রক্ষার জন্যই হোক, সেনাবাহিনীতে সৈনিককে অধীন হয়ে থাকতে হয় কঠিন নিয়মানুবর্তিতার , সমস্ত দেশকে স্বাধীন রাখতে গিয়ে এক সৈনিককে উর্দির আবরনে বন্দী হয়ে থাকতে হয় সারা বছর । দেশবাসীর চোখে নিশ্চিন্ত ঘুম আনার জন্য সীমানায় সীমানায় সৈনিক ঘাম ঝরিয়ে যায়, নিজের ইচ্ছা, ভালোলাগা গার্ডরুমের পিছনে গচ্ছিত রাখতে হয় । এই সব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা আমাকে দু এক লাইন লেখার জন্য বহুদূর টেনে নিয়ে গেছে, তবু আমি সেই সব লেখালেখি বাক্সবন্দীই রেখে গেছি, আজ কয়েক দশক অতিক্রান্ত হলো, পুরানো ডায়েরীর ছেঁড়া পাতাগুলি হাতড়ালে আমি আবার সেই সব অভিজ্ঞতাগুলির মুখোমুখী হই, সেই সব ছেঁড়া ছেঁড়া পাতা আমি সুতোয় গাঁথি, কিছু কিছু লাইন নাকি তার কবিতাও হয়ে যায় ।  এই সব জেনেছি যখন কিছু কিছু লেখা দিল্লির লিটল ম্যাগাজিন গুলো ছাপতে শুরু করে ।

এমনিতেই দিল্লিতে বাংলা কবিতার পাঠক সংখ্যা কম । একটি দুটি ছোট সাহিত্য সংস্থা পার্ট টাইম কবিদের নিয়ে আড্ডা বসায়, সেখানেই আমার কবিতার প্রথম প্রকাশ । অধিকাংশ লেখাগুলি তখনো বাক্স বন্দী । এরকমই কোন কোন আসরে যেতে যেতে হঠাৎই খেয়াল হলো, লেখাগুলি ডায়েরী থেকে এনে টাইপ করে ফেললে ভালো হয় এবং টাইপ হয়ে গেলে, অগুলো বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিনে ও ব্লগে দেওয়া যায় । ফেসবুকেও লেখাগুলি পোস্ট দিতে থাকি । বিংগো ! অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া । বাড়তে থাকে পাঠকের সংখ্যা, দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য দেশ / প্রদেশ থেকে আসতে থাকে প্রতিক্রিয়া । সেই সাথে নিজেকে কবি কবি ভাবতে থাকি আমি আর কিছু কিছু নতুন লেখাও লিখতে থাকি । মূলতঃ এই সব লেখাগুলি আমার বায়ুসৈনিক কর্মকান্ড, মিলিটারী প্রোসিজিওর, প্যারেড, শুটিং রেঞ্জ, আর্মি যুবকদের ব্যর্থ প্রেম কাহিনী নিয়ে যা আমার নিজে দেখা অভিজ্ঞতা বা নিজের অনুভব করা চিত্রকল্প । কোন কোন কবি বন্ধু আমার এই লেখাগুলি পড়ে আমাকে যুদ্ধের কবি বলেও আখ্যা দিতে চাইলেন আর আমি অনুপ্রানিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার আমি আগুনের মধ্য দিয়ে যাব , যে ভাবেই হোক, একটা বই বের করব যেখানে সব কটি কবিতাই হবে আমার সেই বায়ুসেনিক জীবনের কুড়িয়ে নেওয়া দিনগুলিকে কেন্দ্র করে ।আর সেই মৃত ও জীবিত সৈনিকদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার একটি ছোট্ট প্রয়াসও হবে ।

আমার এই কবিতাগুলি সত্যিই কবিতা কিনা তা পাঠক এবার মুল্যায়ন করবেন এটাই আমার বিশ্বাস এবং এই ধরনের লেখা পরবর্তিতে আরো লেখা যায় কিনা তারও একটা মতামত পাওয়া যেতে পারে বলে একটা আবেদন পাঠকের কাছে আমি রাখতেই পারি । বিশেষ ধন্যবাদ দেব তাঁদেরকে যারা আমাকে এই বইটি করার জন্য উৎসাহ জুগিয়ে এসেছেন । আমার অগ্রজ শ্রী পলাশকান্তি বিশ্বাসও আমাকে সাহস জুগিয়ে এসেছেন এবং তাঁর সহযোগীতায় কলকাতার এক দুটি লিটল ম্যাগাজিনে আমার কবিতা ছেপেও বেরিয়েছে; কিন্তু আমি সেই অর্থে কবি হয়ে উঠিনি । আমাকে নিয়মিত কবিতা লেখার ভূমি প্রস্তুত করে দিয়েছেন "কথাঞ্জলি" পত্রিকার সম্পাদক শ্রী দিলীপ কুমার বন্দোপাধ্যায়, "প্রতিভা পথিকৃৎ" পত্রিকার সম্পাদক ও দিল্লির এক মাত্র বাংলা প্রকাশক শ্রী গোপাল চন্দ্র পাল । এছাড়া আরো অনেকেই আমাকে সাহায্য করেছেন এই বইটি প্রকাশ করার জন্য তাঁদের সবার নাম আমি এখানে উল্লেখ করতে পারলাম না বলে একটু খারাপও লাগছে । তবুও বলি, তাঁদের শুভেচ্ছা ও উৎসাহদানই আমার অনুপ্রেরণার উৎস । তাই সকলকে জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ।


মহাবীর এনক্লেভ                                                                পীযূষকান্তি বিশ্বাস
নিউ দিল্লি
৭ জানুয়ারী ২০১৫


 
   


Friday, August 8, 2014

হীরানগর রেঞ্জে

হীরানগর রেঞ্জে //পীযূষকান্তি বিশ্বাস

মার্চ পথে পড়েছিল এক দো এক
লেফট রাইট ঘুরপাকে
আবাউট টার্ন
বাতাসে বারুদের সিগনাল
এক পা দুপা এগিয়ে আসছিলো
শতছিদ্র পুড়ে যাওয়া টারগেট
ডিটেল ফায়ার !

আতিপাতি হাত পা ছুঁড়ে
সালফারডাই অক্সাইড সাঁতরিয়ে
বুকের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনা  
হিম শীতল খনিজ অনুভুতি
অতল গভীরে তার লেয়ারে লেয়ারে স্থবীর
বুলেটের শায়িত মৃতদেহ

পিত্তল পিচ্ছিল শরীর, মেদময় শরীরের মত
বারুদ স্থগিত থাকে
ঢাকা দিয়ে রাখে হলুদবরণ ঘুম ...
যেখানে চাঁদমারি উস্কানি দেয় আর দাঁড়িয়ে ঠাই
এই হীরানগর রেঞ্জ
লাইন বাই লাইন
তুমি , আমি,  নায়েক শতীশ কুমার,
হাভিলদার গাইকোয়াড়

ট্রিগারে আঙুল
সন্ধ্যার বাতাসে বাদামী অক্সিজেন,
দিগন্তে চমক পাহাড়ের কোল ঘেসে  
একদল হরিণ ছুটে যায়
নাভির নিচে গনগনে আগুন সামলিয়ে একটানে
আগামী লোনাবালার নিঃশ্বাস বুকে টানি ...

এখানেই অরগাজম !
সুইটস্পটে পাঁচ পা রেখে
বালির বস্তার পাশে ম্যাগাজিন খালি করে

শুয়ে থাকে উত্তপ্ত ম্যাসিন গান ।

Thursday, August 7, 2014

ক্রিমেশন স্যালুট


ক্রিমেশন স্যালুট // পীযূষকান্তি বিশ্বাস

দাঁড়িয়েছিলে খাঁড়া গম্বুজের মত,  
টিলার ওপারে ঠাই স্থির,
দুপায়ে নামিয়ে চোখ
অনেক ভিড়ের উপর
ভিড়টা তোমাকে দেখছিলো,
কিন্তু
ভিড়টা বোধহয় তোমার জন্য ছিলো না

শুধু মেঘ মুখী পতাকায় উড়ছিলো
স্বাধীনতার রং
প্রতিটা রক্তবিন্দু মুছে দিয়ে কার্গিলের প্রান্তর
সন্ধ্যা গোধুলি হতে চেয়েছিলে বুঝি

এই টিলার পাদদেশে দাঁড়ানো
নুড়ি পাথর ও বৈশাখী
তুমি হেঁটে আসো খাইবার পার হয়ে
তোমার প্রতিটা পদক্ষেপে
বিন্দু বিন্দু ডটে

মানচিত্র হেঁটে যায়,  
সীমানা এখানেই পড়ে থাকে,
মুখ থুবড়ে

তুমি তাই হাঁটুমুড়ে বসে পড়ো পরিখার পাশে
মাটির খুব কাছে
দুমড়ে মুচড়ে
ঘাস কামড়ে ধরো

ত্রিরঙ্গা ওড়ে,
বাতাসে মুক্তির সুবাস

'স্যালুট'

একটা কথাই আমার কলমে উচ্চারিত হয়,
এতটাই স্পষ্ট 
ঠিক যতটা আওয়াজে তুমি বুঝতে পারো
তোমার বুলেট ছিদ্র বুকের উপরে

আমরা ফুলের মালা রেখেছি ।