সকলে কবি নয়, কেউ কেউ কবি, কথাটি সর্বজনস্বীকৃত সত্য । পাঠকবন্ধুরা সকলেই
তাঁদের উপলব্ধির ভিত্তিতে বিচার করেন কোন কবিতা গ্রহণযোগ্য আর কোনটি নয়! কোন
কবিতাটি তাৎপর্য্যপূর্ণ কিংবা কোনটি ছন্দানুসারী; আবার কোনটি অর্থহীন কিছু কথার সমষ্টি মাত্র ।
আসলে বিশ্বব্রম্মান্ডের দেখা অদেখা সমস্ত বিষয়বস্তু কবির হৃদয়কে স্পর্শ করে ভাবনার
আলোড়ন তুলতে পারে এবং নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য উৎসাহিত করতে পারে ।
তাই বলা যায় কবির মনোজগৎ এক উন্মুক্ত বাতায়ন আর
তাঁর মধুময় কলমের স্পর্শে পাঠকমহলে সৃষ্টি হয় এক স্বপ্নময় অনুভূতি । যে কবির
পাঠকমনে যত বেশী ব্যাপ্তি কালের বিচারে
তার বিস্তারও তত বেশী । তাই আমরা নিয়ত পরিচিত হই নতুন নতুন লেখকবন্ধুদের সঙ্গে
যারা তাঁদের স্বপ্ন কাজলে এঁকে দেন আমাদের হৃদ্দেশে নতুন এক সৌভিক অনুভূতি ।
তেমনই এক তরুন কবিকে আমরা পেয়েছি যিনি মাত্র ১৭
বছর বয়সে বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন । তিনি নিয়ে এসেছেন তাঁর সামরিক অভিজ্ঞতার
ডালি এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে । গ্রন্থকার শ্রী পীযূষকান্তি বিশ্বাস এর জন্ম
পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামে । পিতা স্বর্গত শ্রী জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস
অবসর সময়ে ভক্তিগীতি রচনা ও পরিবেশনা করতেন । আর অগ্রজ শ্রী পলাশকান্তি বিশ্বাস
একজন সুপরিচিত কবি ও সাহিত্য বোদ্ধা । এই পারিবারিক পরিমন্ডল একদিকে আর অন্যদিকে
সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা পীযূষকান্তিকে কবিতা রচনায় সতত উদ্দীপিত করেছে; সেই সঙ্গে বাংলার কাব্য ভান্ডারে যুক্ত করেছে
বেশ কিছু যুদ্ধ ভিত্তিক কবিতা এবং সেই সব সংগ্রামী জীবনের বিবিধ কাহিনী ও
নিত্তদিনের অভিজ্ঞতা ।
তাই তাঁর 'জীবাশ্ম' কবিতায় পাই এক সৈনিক জীবনের উপলব্ধিঃ
"বেয়নটের ফলাকায় মাখানো অচেনা বিষ /ঘাড়ের পরে অহরহ বুলেটের নিঃশ্বাস /গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে আর ডি এক্সের ধোঁয়া
বাঁচিয়ে /বাঁচিয়ে রেখেছি এই প্রেম /পথ চেয়ে বসে আছে বিবাহ বাসর ।" সৈনিক জীবনের অর্পিত কর্তব্য বনাম
হৃদয় উদ্বেলিত প্রেমের বাস্তব ছবি আমরা দেখতে পাই কবির অনেক কবিতার ছত্রে ছত্রে;
যেমন "বিকানীরের
বৈকালে বিশাল দিগন্তে ক্লান্ত নোন্তা ঘাম লু হাওয়া লুটে খায়/ তোমাকে আমার তখন মনে
পড়ে অসীমা, অ্যাংকলেট
বুটপায়ে নেমে পড়ি রাস্তায়..." ( বিকানীরের সূর্যাস্ত )। "মিগ টোয়েন্টি
ওয়ান" কবিতায় কবির বিদ্রোহী মন তুলে ধরেছে এক চিন্তনীয় প্রশ্নঃ " আমি বড় হয়রান মৌসুমি , কিংকর্তব্যবিমুঢ় / কিসের যুদ্ধ এ ? / কাদের লড়াই / নিজেরই বুকে ক্ষত নিয়ে কৃত্রিম সীমানার বড়াই ?"
জীবনে অনেক সময়ে আমাদের পরিশ্রম অর্থহীন হয়ে
পড়ে, যদিও পরিশ্রম এক নিত্যনৈমিত্তিক
জীবনধর্ম । কর্মক্ষেত্রে বা সংসার জীবনে বিনা পরিশ্রমে ফল মেলে না, এ কথা জানা সত্বেও পরিশ্রমী জীবনকে বেছে নিই ।
কবিও নিয়েছেন, কিন্তু তবুও দেখি
কখনো কখনো হতাশা তাঁর হৃদয়কে স্পর্শ করে গেছে , যখন দেখি তিনি
লিখেছেন , "গর্দনটা নিচে ঝুঁকিয়ে দেখলে মাটি দেখা যায় /
যেখানে ঝরে পড়ছে প্রতিদিন / পরাজিত ঘাম " (ঘুমের দেশে) , এ এক অদ্ভুত বাস্তব অনুভূতির স্পর্শ ।
বিশ্বজুড়ে আমরা যে সংগ্রামের ছবি নিত্য দেখি তা
এক মানব জীবনের বেদনাভরা আলাপন । দেশে দেশে মানুষে মানুষে সখ্যতার অভাব এবং
ক্ষমতার আস্ফালন ও বৈরী মনোভাব পারিপার্শ্বিক আবহাওয়াকে বিষিয়ে তুলেছে। তার
অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো জীবন ও সম্পদের অবক্ষয় । ফলতঃ দেশের ভিতরে বাইরে নানা
কারণে নিয়ত দ্বন্দের সৃষ্টি । কবি শ্রী পীযূষকান্তি পাঠক বন্ধুদের সামনে এক মুল্যবান প্রশ্ন তুলে
ধরেছেন তাঁর "জলজ শ্যাওলা" কবিতায়..."ভু-ফোঁড়ে জনকের /প্রতিনিয়ত এই রকম শহীদ প্রসব / হা ঈশ্বর, / কে নিয়ে আসে এদের সংগ্রামী মৃত্যু ?..." এক চিরন্তন
জিজ্ঞাসা যার উত্তর হয়ত মানুষের আজও অজানা তাই তা তিনি ঈশ্বরের কাছেই তুলে ধরেছেন
।
কবিতা নিয়ে বিশেষ পরীক্ষা - নিরীক্ষার শুরু
রবীন্দ্র পর্বের শেষ দিক থেকে যখন কিছু নতুন কবি তাঁর অসাধারণ কবিত্ব প্রতিভার
প্রতি অঙ্গুলিসংকেতের মাধ্যমে নিজেদের গুনবত্বা কে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট
হইয়েছিলেন; এবং তা প্রথম
মহাযুদ্ধের সময় থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকাল পর্য্যন্ত খুবই প্রকট হয়ে উঠেছিল ।
ভিক্টোরিয় যুগের ইংরেজী কবি জিরার্ড ম্যানলে হপকিন্স সনাতন চিন্তাধারার অবসান
ঘটিয়ে নিয়ে আসলেন আধুনিক ভাবধারা । তাঁকে অনুসরণ করে এগিয়ে এসেছিলেন মহিলা কবি এমি
লাওয়েল এবং আরও অনেকে । ইংল্যান্ডে জন্ম নিলো 'ইমাজিস্ট' গ্রুপ । বাংলা সাহিত্যেও অনুরূপ চিত্রের
প্রতিফলন দেখতে পাই এবং সে যুগের বহু নামী-দামী কবিকে আমরা পেয়েছি আধুনিক কবিতার
শ্রষ্টা হিসাবে । তাঁরা বাংলা কাব্য জগতে
রবীন্দ্রধারাকে অগ্রাহ্য করে নতুনত্বের সন্ধানে ব্রতী হওয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছিলো
একথা যেমন সত্যি, তেমনি পাঠক
পেয়েছিলো নতুনত্বের আস্বাদন - ছন্দে, বিষয়বস্তুতে, ভাষায় ও
প্রকাশভঙ্গীতে । বর্তমান কাব্যগ্রন্থে শ্রী পীযূষকান্তি বিশ্বাস সেই নতুনত্বের
ডালি আমাদের উপহার দিয়েছেন যা পাঠকমনে এক অভিনব ছাপ রেখে যাবে বলে বিশ্বাস করি ;
বিশেষ করে সমগ্র গ্রন্থটি
হয়ে উঠেছে সামরিক জীবনের এক বাস্তবানুভূতি ও তার মুল্যবান চিত্রকল্প ।
আনুমানিক ২০০২ সালে যখন শ্রী পীযূষকান্তি
প্রথমবার আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিলেন । তখন তাঁর কয়েকটি কবিতার মাধ্যমে তাঁর
কাব্য প্রতিভার পরিচয় আমি পেয়েছিলাম । প্রতিভার মুকুলটি যাতে তার বিশেষত্ব বজায়
রেখে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে সে জন্য নিয়ত তাঁকে উৎসাহিত করে এসেছি । আস সে পুষ্পবৃক্ষ
আপন মাধুর্যে বিদ্যমান ।
তাই গ্রন্থকার শ্রী পীযূষকান্তি বিশ্বাসকে
জানাই সুদীর্ঘ ও সাফল্যময় কাব্যজীবনের আন্তরিক শুভেচ্ছা ।
২ জানুয়ারী ২০১৫ দিলীপকুমার
বন্দোপাধ্যায়
নতুন দিল্লি (প্রাক্তন
প্রধান সম্পাদকঃ কথাঞ্জলী)
No comments:
Post a Comment